শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৮:৫৪ পূর্বাহ্ন
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : চট্টগ্রাম নগরীর মনসুরাবাদস্থ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে পরিচালকের যোগসাজশে দালালদের অবলীলা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিলছে না কাঙ্খিত সেবা, বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করা হচ্ছে গ্রাহকদের। এ কার্যালয়ে বিভাগীয় পরিচালক হিসেবে মো. সাইদুল ইসলাম যোগদানের পর থেকে গড়ে উঠেছে চিহ্নিত দালাল চক্রের নতুন কর্মসংস্থান।
বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে গ্রাহক বা সেবা প্রার্থীদের প্রবেশ করতে হলে মূল গেইটে জনৈক বহিরাগত লোকের কাছে থাকা রেজিস্ট্রারের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ও কি কারণে এসেছে তা বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করতে হয়। কিন্তু দালালদের প্রবেশে কোন ধরনের বাধা নেই কিংবা রেজিস্ট্রারে তাদের নাম-ঠিকানাও লিখতে হয় না।
পরিচালকের নির্দেশনায় তার বাসভবনের সিঁড়ি সংলগ্ন নিচতলার ১০৭ নম্বর কক্ষে বহিরাগত দালাল দিয়ে পাসপোর্টের আবেদনপত্রগুলোর ‘বিশেষ চিহ্ন’ বাছাই করার কাজে কয়েকজনকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। আবেদনপত্র যাচাই-বাছাইয়ে অফিসের কতিপয় কর্মচারী তাদেরকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
যোগদানের কিছুদিন পর অসৎ উদ্দেশ্যে দালালদের সঙ্গে গোপন বৈঠকও করেন পরিচালক সাইদুল। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা তদন্তনাধীন রয়েছে। কর্তৃপক্ষকে মাসোহারা দিয়ে ম্যানেজ করার জন্য তারা কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে একটি ফান্ড তৈরি করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে, বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. সাইদুল ইসলামের সঙ্গে দালালদের অঘোষিত চুক্তি (টাকার বিনিময়ে) থাকার কারণে তাদের মাধ্যমে জমাকৃত ‘বিশেষ চিহ্নিত’ পাসপোর্ট আবেদনের ফাইলগুলো খুব দ্রুততার সঙ্গে হালনাগাদ করা হয়। দালালদের ‘বিশেষ চিহ্ন’ ব্যতীত ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কিছু সাধারণ গ্রাহক তাদের পাসপোর্ট আবেদন জমা করলেও সেগুলো দৈনিক হালনাগাদ করা হয় না বলে অভিযোগ উঠেছে। দিন শেষে ‘বিশেষ চিহ্ন’ ব্যতীত আবেদনগুলো সাবমিট না দিয়ে আলাদা করে রেখে দেওয়া হয়। জরুরি পাসপোর্ট আবেদনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কিছু কিছু সাধারণ গ্রাহক রি-ইস্যু পাসপোর্ট আবেদন করার পর অনলাইনে চেক করে যখন বুঝতে পারেন যে আবেদন হালনাগাদ করা হয়নি তখন প্রাপ্তি স্বীকারপত্রের তারিখ অনুযায়ী পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে গেলে তারা জানতে পারেন, পরিচালকের নির্দেশে কর্মচারীরা আবেদনগুলো সঙ্গে সঙ্গে আপলোড না দিয়ে ১০-১৫ দিন বিলম্বে আপলোড দেয়ায় যথাসময়ে পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
নমুনা হিসেবে পাসপোর্ট অবেদনের ফাইল নং- ৪০০৬-০০০৪৩৩১৪৮, ৪০০৬-০০০৪৩১৬৫৪, ৪০০৬-০০০৪২৮৬৯৩, ৪০০৬-০০০৪৩৫৮৫৬, ৪০০৬-০০০৪৩৫৫৬৭ ও ফাইল নং- ৪০০৬-০০০৪২৮২৫৭। শুধুমাত্র পরিচালক ও গুটি কয়েক কর্মচারী অফিসকে জিম্মি করে রাখার কারণে এ রকম আরও অসংখ্য আবেদনকারী প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে। জমাকৃত কিছু কিছু আবেদন পত্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট সরিয়ে আবেদনগুলোকে অবজেকশনে রেখে কতিপয় কর্মচারী তাদের কর্মকর্তার নাম বলে আবেদনকারীদের নিকট থেকে অর্থ আদায় করে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব কিছুর মূলহোতা বিভাগীয় এই পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়া নতুন পাসপোর্ট আবেদনকারীদের পুলিশ প্রতিবেদনের জন্য সিটিএসবি বা ডিএসবিতে প্রেরণেও গড়িমসি করার কারণে তারাও নির্দিষ্ট সময়ে পাসপোর্ট পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভুক্তভোগী গ্রাহকরা এ বিষয়ে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে পাসপোর্ট পাইতে আরও ১৫/২০ দিন সময় লাগতে পারে বলে জানান।
অথচ দালাল চক্রের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে পাসপোর্ট আবেদন জমা করলে নির্দিষ্ট সময়ে পাসপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে বলেও একজন ভুক্তভোগী জানান।
এদিকে গত ৩ ডিসেম্বর রবিবার মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসে হাবিবুল হাসান রনি ও শাকিল নামে ২ সেবা প্রত্যাশীকে খুব দ্রুত সময়ে পাসপোর্ট পাইয়ে দেওয়ার জন্য কর্মকর্তার নামে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে কর্মচারী সাদী। এ বিষয় নিয়ে অফিসে বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায়ে রনি ও শাকিলদকে আটকে রেখে মারধর করে কর্মচারী সাদী। খবর পেয়ে মারধরের শিকার সেবাপ্রার্থী রণির ভাই আইনী সহযোগিতা চেয়ে জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করার পর সিএমপির ডবরমুরিং থানার এসআই জানে আলম ঘটনাস্থলে পৌঁছে রনি ও শাকিলকে উদ্ধার করে।
হাবিবুল হাসান রনি বলেন, টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে শাকিল ও আমাকে মারধর করে আটক রাখে। খবর পেয়ে আমার ভাই জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করলে ডবলমুরিং থানা পুলিশ আমাদেরকে উদ্ধার করে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পরিচালকের নির্দেশনায় তার বাসভবনের সিঁড়ি সংলগ্ন নিচতলার ১০৭ নম্বর ও ২য় তলার ২০৭ নম্বর কক্ষে বহিরাগত দালাল দিয়ে পাসপোর্টের আবেদনপত্রগুলোর ‘বিশেষ চিহ্ন’ বাছাইপূর্বক ফাইলগুলো আলাদা করে রাখার কাজে মো. রেজাউল করিম, মোহাম্মদ বেলাল, মোহাম্মদ সেলিম ও অনিকসহ আরও কয়েকজন ব্যস্ত থাকেন।
আবেদনপত্র যাচাই-বাছাইয়ে পরিচালকের একান্ত আস্থাভাজন অফিস সহকারী মো. সাইফুদ্দিন, উচ্চমান সহকারী মো. জসিম উদ্দিন, সুপার শওকত আলী মোল্লা ও হিসাব রক্ষক মো. সুমন তাদেরকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন বলে প্রাপ্ত তথ্যে প্রকাশ। এছাড়া কোনো কোনো কর্মচারী পরিচালকের আদেশ/নির্দেশ মানতে অনীহা প্রকাশ করলে মহাপরিচালকের (ডিজি) ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদেরকে বদলি করানোর হুমকি দেওয়া হয় বলে প্রাপ্ত তথ্যে প্রকাশ।
সূত্রমতে, মনসুরাবাদস্থ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের সামনে একটি ব্যাংক বুথ ছাড়া আশপাশে আগে থেকেই আর কোনো ধরনের দোকানপাট ছিলো না। বর্তমান সময়ে অফিসের আশপাশে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ভাসমান দোকান। অপেক্ষমান আবেদনকারীরা যে কোনো প্রয়োজনে নির্দিষ্ট দালালের কাছে যাওয়ার জন্য ঐসব দোকানিরা উদ্বুদ্ধ করে।
এ ব্যাপারে বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মো. সাইদুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়গুলো অস্বীকার করেন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের অনিয়ম, দুর্নীতি ও দালালচক্রের আধিপত্য বিস্তারের বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের নিরপেক্ষ তদন্তকালে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে জানান ভুক্তভোগী সেবা প্রার্থীরা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে অনিয়ম ও গ্রাহক হয়রানি রোধসহ দালালমুক্ত সেবা নিশ্চিত করতে ভুক্তভোগীরা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও দপ্তরের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।